ভৌগলিক অবস্থান: ইউরোপ পৃথিবীর উত্তর দিকে অবস্থিত। এর উত্তরে ব্যারেন্টস সাগর, দক্ষিনে ভূমধ্যসাগর, পূর্বে এশিয়া মহাদেশ এবং পশ্চিম আটলান্টিক মহাসাগর রয়েছে। চতুর্দিকে জলরাশির পরিমাণ বেশি থাকায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এই মহাদেশের দেশগুলো বৈশ্বিক যোগাযোগ ও বাণিজ্য সুবিধা ভোগ করে থাকে। বিশেষ করে আমেরিকা এবং এশিয়া মহাদেশ হতে যাবতীয় বাণিজ্য ভূমধ্যসাগরের মাধ্যমে হয়ে থাকে। বিশ্বের বৈদেশিক বাণিজ্যের ৯৭% জলপথ, ২% স্থলপথ এবং ১% আকাশপথে হয়। এজন্য ইউরোপ মহাদেশের দেশসমূহ নীল অর্থনীতিতে বিশেষ সুবিধা পায়।
নীল অর্থনীতি (সমুদ্র বা পানি কেন্দ্রিক অর্থনীতি)
ভৌগোলিক আবিষ্কার: ১৪৮৭ সালে পর্তুগিজ নাবিক বার্থোলোমিউ দিয়াজ ইউরোপ থেকে আটলান্টিক মহাসাগর এবং আফ্রিকা মহাদেশের সর্বদক্ষিণের জলপথ উত্তমাশা অন্তরীপ(Cape of Good Hope) পার হয়ে ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল আফ্রিকা এবং এশিয়ার পৌঁছেছিল। ডিয়াজের আগমনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ব্যবস্থায় উপনিবেশিক যুগের সূচনা হয়। এজন্য ১৫ শতকের শেষ সময়কে "স্টার্টিং এরা কলোনিয়ালিজম” বলা হয়।
ডিয়াজের আগমনের পর পর্তুগিজ বণিক সম্প্রদায়ের লোকেরা আফ্রো এশিয়া অঞ্চলে আসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পর্তুগীজদের আগমনের মাধ্যমে শুরু হয় উপনিবেশ যুগ। এই আগমনের উদ্দেশ্য ছিল-
১। শিল্পের কাঁচামাল সংগ্রহ
২। সস্তা শ্রমিক
এই উপনিবেশ থেকে প্রাপ্ত সম্পদ এর মাধ্যমে ইউরোপের অর্থনীতি অগ্রসর হওয়া শুরু করে।
অন্যান্য দেশসমূহের আগমন: পর্তুগালের আগমনের পর ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সমূহ এ সকল অঞ্চলে উপনিবেশ স্থাপন করে। অধিকাংশ উপনিবেশ ইংল্যান্ড দখল করে নিয়েছিল এজন্য ইংল্যান্ডকে কলোনিয়াল মাস্টার বা উপনিবেশী প্রভু বলা হয়।
উপনিবেশিক দ্বন্দ্ব নিরসন: উপনিবেশিক দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য ১৮১৫ সালে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনাতে ১ম সম্মেলন হয়। এ সম্মেলনের নাম ছিল "ভিয়েনা সম্মেলন"। এ সময়ে উত্তর আফ্রিকা ফ্রান্সের দখলে, লিবিয়া ইতালির দখলে, ইন্দোচীন(লাউস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম) ফ্রান্সের দখলে এবং অ্যাঞ্জোলা পর্তুগালের দখলে ছিল।
১৮৭০ সালে জার্মানি ফ্রান্স এর দুটি শহর আলসেস ও লরেন দখল করে। ফলে ইউরোপে নতুন দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এই দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য ১৮৮৪-১৮৮৫ সালে জার্মানির বার্লিন শহরে ২য় সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনের নাম ছিল "বার্লিন সম্মেলন"।
উপনিবেশিক দ্বন্দ্ব ও ১ম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা: উপনিবেশিক দ্বন্দ্বের ফলে অর্থাৎ ভৌগলিক হস্তক্ষেপের কারণে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয় এবং ১৯১৮ সালে শেষ হয়। এ যুদ্ধে দুটি পক্ষ ছিল-
১। অক্ষশক্তি (জার্মানি + ইতালি + অস্ট্রিয়া + হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড)
২। মিত্রশক্তি (আমেরিকা + যুক্তরাজ্য + ফ্রান্স + রাশিয়া ও জাপান)
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯১৭ সালে যুক্তরাজ্য এবং ইতালির মধ্যে একটি গোপন চুক্তি হয়। চুক্তিতে যুক্তরাজ্য ইতালিকে বলেছিল মিত্রশক্তির পক্ষে কাজ করলে (যুদ্ধ বন্ধ করলে) চাহিদা অনুযায়ী ইটালিকে পুরস্কার দেওয়া হবে। ইতালি শর্ত মেনে নিয়ে লন্ডনে এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। তাই এই চুক্তি "লন্ডন কৌশল" নামে পরিচিত।
চুক্তি অনুযায়ী ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর মাসে যুদ্ধ বিরতি চুক্তির মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। এই যুদ্ধে মিত্রশক্তি কূটনৈতিক তৎপরতায় জয়লাভ করে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী শান্তি প্রক্রিয়া
প্যারিস শান্তি সম্মেলন: প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিত্রশক্তির উদ্যোগে বিশ্ব শান্তির জন্য ১৯১৯ সালে প্যারিস শান্তি সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সম্মেলনের প্রস্তাবনা নিম্নে দেওয়া হল:
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য জার্মানি দায়ী তাই আমরা যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি তাদের ক্ষতিপূরণ জার্মানিকে অবশ্যই দিতে হবে। এজন্য জার্মানি নিজেকে বঞ্চিত মনে করে নতুন যুদ্ধের ঘোষণা দেয়।
(ইতালিকে লন্ডন চুক্তি অনুযায়ী উপহার না দেওয়ায় ইতালি ও নিজেকে বঞ্চিত মনে করে।)
যুদ্ধ প্রিয় দুই নেতার আবির্ভাব
১৯২১ সালে মুসোলিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী হন। মুসোলিনির নীতি ছিল "War is to Man, Maternity to woman"
পাশাপাশি ১৯৩৩ সালে হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হয়ে যুদ্ধ নীতি ঘোষণা করে বলেন "যুদ্ধই জীবন, যুদ্ধই সার্বজনীন"
১৯৩৭ সালে তারা "বার্লিন-রোম" নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করেন। অবশেষে ১৯৩৯ সালে ১ সেপ্টেম্বর শুরু হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধ।
যুদ্ধ শুরু হলে উপনিবেশিক দেশগুলো সুযোগ পেয়ে জাতীয়তাবাদ আন্দোলন অর্থাৎ স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন শুরু করে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে। ইংল্যান্ড বুঝতে পেরেছিলো যে এই আন্দোলন না থামালে তারা যুদ্ধে হেরে যাবে। তাই তারা ইংল্যান্ড উপনিবেশিক দেশগুলোর দাবি মেনে নেয়। ইংল্যান্ডে উপনিবেশিক স্বাধীনতা আইন পাস হলে আন্দোলন থেমে যায়। ফলে মিত্রশক্তি অর্থাৎ ইংল্যান্ড, আমেরিকা গ্রুপ জয়লাভ করে।
২য় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি জয়লাভ করলে প্রথম দশকে অর্থাৎ ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৫ সালের মধ্যে এশিয়ার দেশ গুলি স্বাধীন হওয়া শুরু করে। দ্বিতীয় দশকে অর্থাৎ ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে আফ্রিকার দেশ গুলি স্বাধীন হওয়া শুরু করে। এমনকি ১৯৬০ সালে একই বছরে আফ্রিকার ১৫-২০ টি দেশ স্বাধীন হয়। এজন্য ১৯৬০ সালকে আফ্রিকার বছর বলা হয়।
যারা উপনিবেশ দখল করে তাদেরকে ঔপনিবেশিক দেশ বলা হয়। যেমন: যুক্তরাজ্য, পর্তুগাল ইত্যাদি।
যে সকল দেশে উপনিবেশ গড়ে তোলা হয় সে সকল দেশকে উপনিবেশিক দেশ বলা হয়। যেমন: দক্ষিণ আফ্রিকার কয়েকটি দেশ দেশ।
আগামী পর্বের আমন্ত্রণ জানিয়ে আজকের পর্ব এখানেই শেষ করছি। সবাই ভালো থাকবেন! সুস্থ থাকবেন! ধন্যবাদ!
Post a Comment