দূর প্রাচ্য বা ফার ইস্ট বা পূর্ব এশিয়ার দেশসমূহ বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সর্বদা আলোচিত। চীন, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান উল্লেখযোগ্য।

 


দূর প্রাচ্য: প্রাচ্য শব্দের অর্থ পূর্ব। পৃথিবীর মানচিত্রে এশিয়া মহাদেশ পূর্বদিকে অবস্থিত। যেহেতু সম্পূর্ণ এশিয়া মহাদেশ পূর্ব দিকে অবস্থিত। তাই এশিয়া মহাদেশের সবথেকে পূর্ব দিকের ৫টি দেশকে "দূর প্রাচ্য" বলে বিবেচনা করা হয়।

এশিয়া মহাদেশের অঞ্চল গুলোর ভিতর থেকে দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নিয়ে গত পর্বগুলোতে আলোচনা করা হয়েছে। এ পর্বে এশিয়া মহাদেশের আরও একটি অঞ্চল দূরপ্রাচ্য নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।

 

দেশের সংখ্যা: দূর প্রাচ্যের দেশের সংখ্যা নিয়ে যে কনফিউশন রয়েছে, সেটি দূর করার চেষ্টা করব। এই অঞ্চলে ৭টি দেশের মধ্যে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হচ্ছে ৫টি। এদের মধ্যে হংকং ও তাইওয়ান স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল অর্থাৎ স্বাধীন সার্বভৌম নয়। হংকং ১৯৪৭ সালে চীনের সাথে একীভূত হয়ে যায়। তবে তাইওয়ান কবে হবে এটা নিশ্চিত নয়। এজন্য এ দেশকে আমরা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। তার কারণ চীনের "ওয়ান চায়না পলিসি"। চীন বলে, "তাইওয়ান বলতে আলাদা কোন দেশ নাই, তাইওয়ান হচ্ছে আমার চীনের একটি অংশমাত্র।" পৃথিবীর যে দেশের সাথে চীনের কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে সেই দেশটি চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক রেখে তাইওয়ানের সাথে কোন কূটনৈতিক সম্পর্ক রাখতে পারবে না। তাইওয়ানের সাথে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক সম্পর্ক পরিচালনা করতে পারবে। আমরা দেখতে পাই, পৃথিবীর অধিকাংশ দেশের স্বার্থ চীনের সাথে বেশি, তাই চীনের সাথে তাদের সম্পর্ক রেখে তাইওয়ান এর সাথে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক সম্পর্ক চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ চীনের যে দাবী "তাইওয়ান বলতে আলাদা কোন ভূখণ্ড নাই, তাইওয়ান হচ্ছে আমার চীনের একটি অংশমাত্র।" এই নীতি মেনে চলা হচ্ছে অর্থাৎ ওয়ান চায়না পলিসি সক্রিয় রয়েছে।  এ কারণে দূরপ্রাচ্যের স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ৫টি। দেশ গুলির নাম নিম্নে বর্ণনা করা হলো-


১। চায়না বা চীন
২। দক্ষিণ কোরিয়া
৩। উত্তর কোরিয়া
৪। জাপান এবং
৫। মঙ্গোলিয়া

 

চীন: গোবি মরুভূমির প্রায় ৬০% এই চীনে অবস্থিত। বাকিটুকু মঙ্গোলিয়ায়। পৃথিবীতে সবথেকে বেশি জনসংখ্যা রয়েছে এই চীনে। তাদের অধিকাংশ লোকই কথা বলে মান্দারিন ভাষায়। আমরা অনেকেই জানি, চীন এবং ভারতের মধ্যে যে সীমারেখাটি রয়েছে সেটির নাম লাইন অব একচুয়াল কন্ট্রোল। চীনের সীমানা স্পর্শ করে মোট ১৪ টি দেশ অবস্থিত।

চীনের রাজনীতি: একসময় তিনি খান রাজ বংশের লোকেরা শাসন করতো। পরবর্তীতে ১৯১২ সালে সান ইয়াৎ সেন এর নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্র অর্থাৎ গণতন্ত্র গঠন করে। ১৯৪৯ সালে মাওসেতুং এর নেতৃত্বে চীনের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হলে গণতন্ত্রপন্থী নেতারা তাইওয়ানে আশ্রয় গ্রহণ করে। চীনে গণতন্ত্রের সময়সীমা ছিল ১৯১২ থেকে ১৯৪৯।

১৯৬২ সালে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট কে কেন্দ্র করে চীন- রাশিয়ার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। এজন্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে চীন বাংলাদেশের বিপক্ষে ছিল। পরবর্তীতে আবার ১৯৮০ থেকে ১৯৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর চীন রাশিয়া সম্পর্ক ভালো হয়। ফলে চীন ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ভালো হয়।

 

কোরিয়া: ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের আদর সিদ্ধান্ত কে কেন্দ্র করে মহাসাগরীয় এলাকা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি হিসেবে ১৯৪৮ সালে কোরিয়া বিভক্ত হয়ে যায় অর্থাৎ স্নায়ু যুদ্ধের সময় কোরিয়া বিভক্ত হয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়। প্রথম ভাগ উত্তর কোরিয়া এবং দ্বিতীয় ভাগ দক্ষিণ কোরিয়া নামে বিভক্ত হয়। উত্তর কোরিয়া রাশিয়াপন্থী সমাজতন্ত্র এবং দক্ষিণ কোরিয়া আমেরিকার পুঁজিবাদ অনুকরণ করা শুরু করে। ফলে ১৯৫০ সালে শুরু হয় কোরিয়া যুদ্ধ। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করে আমেরিকা এবং রাশিয়া। কিন্তু ঐকমত্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হলে রাশিয়ার অনুপস্থিতিতে আমেরিকা জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির জন্য এককভাবে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল তার নাম ইউএফপিআর (UFPR)। বাংলায় এই প্রস্তাবকে বলা হয় "শান্তির জন্য ঐক্য প্রস্তাব"। এর মাধ্যমে কোরিয়া যুদ্ধ শেষ হয়। তবে এই দুই কোরিয়া এক হতে পারেনি। কারণ আমেরিকা এবং রাশিয়ার মধ্যে দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। উত্তর কোরিয়া রাশিয়ার সমাজতন্ত্র পন্থি এবং দক্ষিণ কোরিয়া আমেরিকার পুঁজিবাদ পন্থী। এজন্য দুই কোরিয়া এক হতে পারেনি।

সম্প্রতি উত্তর কোরিয়া আনবিক অস্ত্র পরীক্ষা বৃদ্ধি করলে তা সমাধান করার জন্য আমেরিকা এবং উত্তর কোরিয়া ২০১৮ সালে সিঙ্গাপুরে একটি সম্মেলনের আয়োজন করে। কিন্তু এ সম্মেলনের মাধ্যমে কোনো সমাধান হয়নি।

 

জাপান: ইয়োকোহামা হচ্ছে জাপানের প্রধান বন্দর এবং জাপানকেই সূর্যোদয়ের দেশ বলা হয়।

জাপানের রাজনীতি: একসময় জাপান টিউডর রাজবংশের লোকেরা শাসন করতো। এ সময় থেকেই জাপানের আকাঙ্ক্ষা ছিল নিজ অঞ্চলে (প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে) আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করা। যাকে বলা হয় "স্ফেয়ার অফ ইনফ্লুয়েন্স"। এজন্য জাপান ১৯ শতকের ১৯৮৪ সালে এবং বিশ শতকের ১৯০৫ সালে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ করে জয় লাভ করে। এ যুদ্ধে জাপান রাশিয়ার শাখালিন দ্বীপ এবং কুড়িল দ্বীপ দখল করে নেয়।

১৯৩১ সালে জাপান ও চীনের মধ্যে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে জাপান জয়লাভ করে চীনের মাঞ্চুরিয়া প্রদেশ দখল করে নেয়। সেখান থেকে চীন- জাপান- রাশিয়া দ্বন্দ্ব বিদ্যমান।


জাপান একসময় সামরিক সাম্রাজ্যবাদীদের ছিল। চীন এবং রাশিয়ার সাথে জাপানের যুদ্ধ জয়ের ইতিহাস রয়েছে আমরা উপরে পড়ে এসেছি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিলে জাপান চাপে পড়ে যায়। আমেরিকার এই পররাষ্ট্রনীতিতে জাপান নিজ এলাকায় নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে। এজন্য আমেরিকাকে প্রতিহত করার জন্য জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অক্ষশক্তিতে যোগ দেয়। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত আমেরিকার হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী পাল হারবার আক্রমণ করে। একই দিনে আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সরাসরি যোগদান করে। এর প্রতিশোধ হিসেবে আমেরিকা জাপানে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট ও ৯ আগস্ট যথাক্রমে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে আণবিক আক্রমণ করে প্রতিশোধ নেয়। ‌পরবর্তীতে ১৯৫২ সালে জাপান নতুন সংবিধান চালু করে যাকে শান্তি সংবিধান বলা হয়। তবে এই আক্রমণের পূর্বে ১৯৪৫ সালের ২৬জুলাই আমেরিকা ইংল্যান্ড এবং চায়না এক যৌথ ঘোষণায় বলেন যে, জাপান যদি ক্ষমা চায় তাহলে প্রতিশোধ নেওয়া হবে না।

 

মঙ্গোলিয়া: এই দেশটির উত্তরদিকে রাশিয়া, অন্যান্য দিকে অর্থাৎ পূর্ব, দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে চীন রয়েছে। ভৌগোলিক দিক দিয়ে মঙ্গোলিয়ার কোন জল সীমান্ত নাই। গোবি মরুভূমির কিছু অংশ এই মঙ্গোলিয়ায় অবস্থিত।

 

আজ এ পর্যন্তই। আগামী পর্বে মধ্য এশিয়ার রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করব। সে পর্যন্ত সবাই ভাল থাকবেন! নিরাপদে থাকবেন! সুস্থ থাকবেন! ধন্যবাদ!

Post a Comment

Post a Comment (0)

Previous Post Next Post